সদ্য খবর
reporterমাওলাানা মুনীরুল ইসলাম
  ৩ মাস আগে
Shares
facebook sharing button
twitter sharing button
pinterest sharing button
sharethis sharing button

ঘৃণিত ভিক্ষাবৃত্তির নাম যৌতুক

একটি ঘাতক ও ঘৃণিত ভিক্ষাবৃত্তির নাম যৌতুক। যৌতুকের দাবি পূরণ করতে না পারায় ভেঙে গেছে হাজারো বিয়ে, ঘর-সংসার। হারিয়ে গেছে অসংখ্য প্রাণ। যৌতুক দিতে না পারায় হত্যা করা হয়েছে কন্যা, জায়া এবং জননীদের। অত্যাচার চলেছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। পঙ্গুত্ব জীবন কাটাচ্ছে হাজারো মা-বোন। কেটে ফেলা হয়েছে কারো কান, উপড়ে ফেলা হয়েছে কারো চোখ, আগুনে ঝলসে দেওয়া হয়েছে কারো শরীর, ভেঙে ফেলা হয়েছে কারো হাত-পা, এসিড মেরে ঝলসে দেওয়া হয়েছে কারো মুখ। শুধু স্বামী নয়, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ প্রায় সবাই নির্যাতন করে যৌতুকের দাবিতে। প্রিণ্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এসবের খবর আমরা নিত্যদিনই পাচ্ছি। তবুও যৌতুক বহাল তবিয়তে চালু রয়েছে। এ সমাজে যৌতুক প্রদানও হচ্ছে গ্রহণও হচ্ছে।

যৌতুকের পরিচয় : যৌতুক বাংলা শব্দ। এর প্রতিশব্দ পণ। দুটোই সংস্কৃত থেকে এসেছে। হিন্দিতে বলে দহিজ (Dehij), ইংরেজিতে ডাওরি (Dowry)। বিবাহের চুক্তি অনুসারে কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে বা বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে যে সম্পত্তি বা অর্থ দেয় তাকে যৌতুক বা পণ বলে। (বাংলাপিডিয়া : ৮/৪৫৫)

বাংলাদেশের ১৯৮০ সালের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে যৌতুকের যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে তা নিম্নরূপ : যৌতুক অর্থ (ক) কোনো এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে, অথবা (খ) বিবাহের কোনো এক পক্ষের পিতা-মাতা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক অন্য কোনো পক্ষকে বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিবাহের মজলিসে বা বিবাহের পূর্বে বা পরে যে কোনো সময়ে বিবাহের পণরূপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রদানে অঙ্গিকারাবদ্ধ যে কোনো সম্পত্তি বা জামানত। (যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০, আইন নং ০৫)

২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। এতেও যৌতুকের ব্যাপক সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ আইনটি ২০০৩ সালে সংশোধন হয়। সংশোধিত আইনে যৌতুকের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা হলো, যৌতুকের অর্থ (অ) কোনো বিবাহে বর বা বরের পিতা-মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সাথে জড়িত বরপক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে বিবাহের পণ হিসেবে অন্য পক্ষের নিকট দাবিকৃত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ। অথবা (আ) কোনো বিবাহের কনেপক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সাথে জড়িত বরপক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তিকে উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপরে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে বিবাহ স্থির থাকার শর্তে বিবাহের পণ হিসাবে প্রদত্ত বা প্রদানে সম্মত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ। (ধারা-২, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন [সংশোধন] আইন ২০০৩)

তবে দেনমোহর যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত নয়। যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০ তে যৌতুকের সংজ্ঞা দেওয়ার পর বলা হয়েছে, শরীয়ত মোতাবেক প্রদেয় দেনমোহর, বা মোহরানা ইহার অন্তর্ভুক্ত নহে। (যৌতুক নিষিদ্ধ আইন ১৯৮০, আইন নং ৩৫)। ভারতের ১৯৬১ সালের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন থেকেও মোহরকে বাদ দেওয়া হয়েছে। (বাংলাপিডিয়া : ৮/৪৫৫)

যৌতুকের উৎপত্তি : যৌতুকের উৎপত্তি সম্বন্ধে সুনির্ধারিত কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। অধুনা এ বিষয়ে গবেষকগণ এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে যা লিখেছেন এর সারমর্ম হলো, প্রাচীন হিন্দুসমাজে এর উৎপত্তি হয়েছে, এটি প্রায় স্বীকৃত। প্রাচীন হিন্দুসমাজে এটি ছিল কন্যাপণ অর্থাৎ বরপক্ষ কনে পক্ষকে দিত। কনেপক্ষ বিয়ের মাধ্যমে তাদের একজন সদস্য হারাচ্ছে এর ক্ষতিপূরণের জন্য কনের পরিবারকে বরপক্ষ কর্তৃক বিভিন্ন সম্পদ দিত। কালক্রমে এটি বরপণে রূপ ধারণ করে। (বাংলাপিডিয়া : ৮/৪৫৫)

হিন্দুদের এই কন্যাপণের সঙ্গে ইসলামের মোহরের কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা, কন্যাপণ দেওয়া হত ক্ষতিপূরণের জন্য কন্যার পরিবারকে, কন্যাকে নয়। আর মোহর দেওয়া হয় কন্যার সম্মানী হিসাবে স্বয়ং কন্যাকে, কন্যার পরিবারকে নয়। হিন্দুসমাজের কন্যাপণ কালক্রমে বরপণে রূপান্তরিত হওয়ার পেছনে যেসব কারণ রয়েছে এগুলোর অন্যতম হলো কুলিনত্ব। প্রাচীনকালে অনার্যরা সমাজে মর্যাদা পাওয়ার আশায় আর্যদের কাছে তাদের কন্যা সম্প্রদান করত। বিনিময়ে মোটা অংকের সম্পদ দিত। তখন থেকেই যৌতুক প্রথা কালক্রমে একটি সামাজিক রূপ নেয়। (ইসলাম ও যৌতুক)

হিন্দুসমাজের এই শ্রেণীবৈষম্য বা কুলিনত্বের কারণে হিন্দুসমাজে আজো যৌতুক প্রথা বেশি প্রচলিত। বিশেষ করে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মাঝে এর প্রচলন অনেক। উনবিংশ শতাব্দিতে দেখা যায়, উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণরা অধিক পরিমাণ যৌতুক পাওয়ার আশায় শতাধিক বিবাহ করত। এসব স্ত্রী তাদের পিতৃগৃহেই থাকত। স্বামীরা বছরে একবার দেখা করতে আসত এবং অনেক আতিথেয়তা ভোগ করে যাওয়ার সময় অনেক যৌতুক নিয়ে যেত। (বাংলাপিডিয়া : ৮/৪৫৫)

আর হিন্দুসমাজের উত্তরাধিকার আইনকে যৌতুক প্রথার উৎপত্তির একটি মৌলিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হিন্দু-আইনের মিতাক্ষারা ও দায়ভাগ উভয় মতবাদের আলোকেই সাধারণত কন্যা পিতার সম্পত্তি পায় না। বিশেষ করে দায়ভাগ মতবাদ অনুযায়ী সম্পত্তিতে বিবাহিতা কন্যার অংশিদারিত্ব অনেকটাই অনিশ্চিত। হিন্দু আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র বা বিধবা থাকতে কন্যা পিতার পরিত্যক্ত সম্পদ লাভ করতে পারে না এবং অবিবাহিতা কন্যা বিবাহিতা কন্যার উপর প্রাধান্য পায়। কন্যা কখনো এই সম্পত্তি পেলে তা শুধু ভোগের অধিকার থাকে। তাতে স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। (হিন্দু আইন, পৃষ্ঠা ৩৫)

মোটকথা, হিন্দু সমাজের বিভিন্ন রীতিই বর্তমান ভয়াবহ যৌতুক প্রথার উৎপত্তির মূল কারণ। ১৯ শতক থেকে ২০ শতকের মধ্যে ইউরোপেও এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় (ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা)। কিন্তু প্রাচীন মুসলিম সামজে যৌতুকের কোনো অস্তিত্ব ছিল বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় না।

ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকায় এর ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এতে রয়েছে, বিংশ শতকের শুরুতে হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজকে যখন যৌতুক প্রথা অস্থির করে তুলেছিল, তখন মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ দুশ্চিন্তামুক্ত ছিল। শুধু তাই নয়, মুসলিম সমাজের মেয়েদের কদরও ছিল অনেক বেশি। দীর্ঘদিন যাবৎ হিন্দু সমাজ ও মুসলিম সমাজ একত্রে বসবাসের কারণে সাম্প্রতিককালে আরো বিভিন্ন কুপ্রথার মতো এই যৌতুক কুপ্রথাটিও মুসলিম সমাজে সংক্রমিত হয়। (ইসলামের বৈধ ও নৈতিক প্রেক্ষাপট, পৃষ্ঠা ৫২৮)

  • সর্বশেষ