কিশোর গ্যাং, এখনই সময় রুখে দাঁড়ানোর

সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য এখন এক ভয়াবহ বাস্তবতা। এক সময়ের স্কুলের ইউনিফর্ম পরা শিশু-কিশোররা আজ দলবদ্ধ হয়ে অপরাধের জগতে প্রবেশ করছে অবলীলায়। তাদের হাতে মোবাইল, হাতে ব্লেড, কোমরে ছুরি—একটি বিকৃত ‘বীরত্বের’ প্রতিযোগিতায় নেমেছে যেন তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানিমূলক ভিডিও বানানো, এলাকায় প্রভাব বিস্তার, প্রকাশ্যে মারামারি ও ছিনতাই—এ সবকিছুই এখন গ্যাং কালচারের স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতির সমাধানের জন্য শুধু শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর দোষ চাপালে হবে না। গণমাধ্যমে সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত দেখছি কিভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই কিশোর গ্যাংদের বিষয়ে কঠোর ভূমিকা নিচ্ছে। মূলত ঐক্যবদ্ধ ভাবে পরিবার ও গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে দায়িত্ব নিয়ে কিশোরদেরকে আলোর পথে নিয়ে আসতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে—এই কিশোররা কোথা থেকে এল? পরিবারে অবহেলা, সমাজে অস্থিরতা, শিক্ষা ব্যবস্থায় অনুশাসনের অভাব, নৈতিক শিক্ষার অভাব, প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং তরুণদের জন্য বিনোদন বা সৃজনশীলতার অভাবে কিশোররা ভুল পথে যাচ্ছে। অনেক অভিভাবক সন্তানকে সময় না দিয়ে মোবাইল কিংবা অর্থ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছেন। আর সেই ফাঁকেই প্রলোভনের হাত বাড়ায় গ্যাং নেতারা।
অন্যদিকে, কিছু রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এদের একটি অংশ অস্ত্র ধরে। মিছিল-মিটিংয়ে ব্যবহৃত হয়ে, তারা ধীরে ধীরে অপরাধকে ‘সাহস’ হিসেবে দেখছে। ফলে আইনকে ভয় না পেয়ে উল্টো প্রকাশ্যে অপরাধ করাও এখন ‘নতুন সাহসিকতা’ হিসেবে ছড়াচ্ছে।
পরিবার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা কে ঢেলে সাজাতে হবে। । প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত নজরদারি ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম রাখা জরুরি। দেখা যায় স্থানীয়ভাবে অভিযোগ করা হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে গ্যাং সদস্যরা ধীরে ধীরে আরও সাহসী ও সহিংস হয়ে ওঠে।
এখন প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ—যেখানে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও মিডিয়া—সবাই একযোগে কাজ করবে।
পরিবারকে সন্তানকে সময় দিতে হবে, তাদের মনের কথা শুনতে হবে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, রাতে ঘরে ফিরছে কিনা—এগুলো খেয়াল রাখতেই হবে।
বিদ্যালয়গুলোতে কিশোর অপরাধ বিষয়ে সচেতনতামূলক ক্লাস চালু করা যেতে পারে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা যেমন প্রয়োজন, তেমনি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও কিশোরদের যুক্ত করা জরুরি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শুধু ধর-পাকড় নয়, বরং কিশোর অপরাধ রোধে তথ্যভিত্তিক নজরদারি ও গ্যাং লিডারদের গ্রেফতারে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি পুনর্বাসনের জন্য আলাদা প্রক্রিয়া থাকতে হবে, যেন কোনো কিশোর একবার ভুল করলেও জীবনের দ্বিতীয় সুযোগ পায়।
মিডিয়াকেও দায়িত্ব নিতে হবে। গ্যাংকে ‘স্টাইল’ হিসেবে না তুলে ধরে এর ভয়াবহতা ও কিশোরদের সম্ভাবনা—এই বার্তা ছড়ানো প্রয়োজন।
সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সমাজে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দায়িত্ববোধের চর্চা ফিরে আনতে হবে। যতদিন না পরিবার ও সমাজ কিশোরদের মানসিক নিরাপত্তা দিতে পারবে, ততদিন কিশোর গ্যাংয়ের মতো ভয়ংকর প্রবণতা থামানো যাবে না।
এখনই সময়—এই উঠতি কিশোরদের হাত থেকে মোবাইল নয়, তুলে দিতে হবে মূল্যবোধের আলো। নয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ ক্রমেই অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
